Saturday, May 30, 2020
রাহেবুলের গদ্য: বিস্বাদ (বিষাদ) উপসংহার
Wednesday, March 4, 2020
কেন লিখি কবিতা - রাহেবুল
কবিতা কেন লিখি? : রাহেবুল
আমি যে একদিন কবিতা লিখব এ কথা কি আমি জানতাম? আমি কি জানতাম আমাকেও একদিন লিখতে হবে? কবিতা নিয়ে তো কোনো প্যাশন
ছিল না কদাচ, আজও যেমন নেই। ঘটনা
হল ওই এগারো ক্লাসে পড়া পর্যন্ত আমি কিছুই
লিখিনি। নিদেনপক্ষে একটা ডায়েরি লেখবার অভ্যেসও ছিল না, সেটা অবশ্য বংশানুক্রমেই স্বাভাবিক ছিল। আম্মা আব্বা
দু’জনেই নিরক্ষর, শুনেছি দাদু-দাদিও ছিলেন তাই। অবশ্য যতখানি নিরক্ষর ততখানি অশিক্ষিত ছিলেন
না আম্মা-আব্বারা। আবার আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে, সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে, রাবীন্দ্রিক আবহের সাংস্কৃতিক পরিবেশ কামনা করাও অবাঞ্ছনীয়
এখানে। কিন্তু নৃতাত্ত্বিকভাবে উত্তরবঙ্গের মূলনিবাসী রাজবংশী হওয়ার সুবাদে নিজস্ব
লোকসংস্কৃতির অভাব ছিল না পরিমণ্ডলে, বিশেষ বাধা ছিল না উদার-মুক্তমনা হওয়ার। বিভিন্ন জাতি, আদিম ধর্মাচার এবং অধিক প্রচলিত ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু প্রভৃতি ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব ছিল না, সমন্বয়ই ছিল অবাধ। এইভাবে বড়ো হওয়া। উপাদান আরও অগাধ রয়েছে
ঠিকই,
যেমন বাপের বংশাণু— আরও কত কি— কিশোরবেলার স্মৃতিতে তা
অক্ষত—'যত নষ্টের গোড়া’ খুঁজলে ওখানেও পাওয়া যাবে অনেক অনেক। এরপর
প্রিয় দুই বন্ধু এরসাদ ও আলি (জুলফিকার) এর সঙ্গে সম্পর্ক-সংঘাত, কত কিছু করতে চাওয়া, তিনে মিলে যেন বিপ্লব সংঘটিত হবে, কত রাত্তির ভাট বকা ভাঙাকুড়ার কালভার্টে বসে কী অধুনা লুপ্ত
কাশিয়াবাড়ির হাটে, জুড়ল ইন্দ্রও। তিন থেকে চার হলাম। এদিকে বিপ্লব আর ব্যর্থতা, ব্যর্থতা আর থমকে না থাকা এসব তখনও ছিল অজানা (আজও কি
সবখানি জানা?)। মাঝে
কুটিল পিরিতি-প্রেম, তারও আগে কামকুম্ভীরের কামড়, ইত্যাকার আদিমতা, আহ্লাদ। আর ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, ব্যক্তিতে পরিবারে, ব্যক্তিতে সমাজে, ব্যক্তিতে ধর্মে, ব্যক্তিতে রাষ্ট্রে শতেক দ্বন্ধ-ধন্ধ, ধাঁধা। এক মরমিয়া, পরম পিয়া মৃত্যু, ওসময় আপনার হয়ে চলেছে। সময়
অতিক্রান্ত হয়; গদ্যে লিখি “মরণরে তুহু মম রাধেসমান”। তখন-এখন, মগডালে ঝুলে আত্মের হনন। তখন সর্বাত্মক ট্রমা-অ্যাঙজাইটি-হ্যালুসিনেশন-নাইটমেয়ার, শীতেঘুম ফ্যান্টাসি। লিখি “ঘুম=মৃত্যু, মৃত্যু=ঘুম”। জানা হয়; পোড়ার দেশে বা কপাল মন্দে বাঁশবিদ্ধ হওয়া
এখানে মনুষ্যনির্ধারিত। মানবিক তেজস্ক্রিয়তার কবলে ধুঁকে প্রতি অঙ্গ মোর। এইরকম
করেই চুঁয়ে চুঁয়ে শরীর-মন-বোধ-বুদ্ধি-সত্তা থেকে বিরামহীন নির্গত হয়ে চলে
টক্সিসিটি, কবিতা।
এইভাবে ভবে জন্ম হয় এক সহজ শয়তানের।
একটা কবিতা, কবিতার
অপেক্ষা করি আমি... এমন একটা কবিতা... সেই আমার পরমপ্রিয় যোনিদ্বার...যাদুবিন্দু...শূন্য...
শূন্যলীন।
এই যেমন;
চিরতরে হারিয়ে যাওয়াটা তো অবশ্যম্ভাবী। মাত্র ক'বছরেই। অথচ এইখানে মানুষের ঢলনামা চিরন্তন। সেটা অতীতে ছিল, আজও রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। একইরকম।
তাহলে এরমধ্যে কী রেখে যেতে পারি পৃথিবীতে? যে যেমন ভাবে। কেউ রেখে যায় সন্তানসন্ততি, কেউ জগন্নাথদের (যারা কিনা ঠুঁটো), কেউ সুরম্য অট্টালিকা, কেউ কেবলই নিজের নরকঙ্কাল। আমি কী রাখব? কী রাখতে পারি? কবিতা? হ্যাঁ একটা কী কয়েকটা কবিতা। সে কবিতা হাতবোমার মতন, হৃদয়ে ব্যথাজর্জর এক বিপ্লবীর মতন, এক ঘামে দরদর চাষা কিংবা ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা’
মুসাফিরের মতন, এক
সাধুসুফিসন্ন্যাসীর মতন... এরকম ভাবি।
কবিতা কি হারায় না? হারিয়ে যায় না কালগর্ভে? বিস্মৃত হয়না মানুষের স্মৃতিতে? হয়। হারিয়ে যায়। বেখবর হয়ে যায়। কতক রয়েও যায় জিয়ন্ত। যার ঠিকেদার সেই মহাকাল। সে কথা তাই
আমি ভাবি না তিলেকও। বরং একজন বেশ্যা-মাগির মতই আমিও
খদ্দেরের অপেক্ষা করি, কালের গর্ভে নিজেকে সঁপে দিই— কালের কাছে জমা রাখি কবিতা।
প্রথম কাব্যি ‘মদীয় ফ্যান্টাসি’ (সৃষ্টিসুখ, কলিকাতা, জুলাই ২০১৯) এর উৎসর্গপত্রে কয়েছি—
“মাহুতমৈষালগাড়িয়ালঘড়িয়াল
ব্লেডবমিবোমাবারুদ
বাউদিয়াবাউলিয়াবাথানবোহেমিয়ান”
কেন এইসব কওয়া?
আসলে বারেবার কতক জিনকোড, কতক বারকোড এড়াতে চায় সিসিটিভির সম্মোহনী চক্ষু। লুকোতে চায় তবু তারা ধরা
পড়ে যায়, রাষ্ট্র
তাদের বায়োমেট্রিক নিলামে তোলে, রাজদ্রোহী বানায়, দেশদ্রোহী বলে—প্রকাশ্যে খাপ বসে। দেশে-বিদেশে-স্বদেশে, গাঁয়ে-গঞ্জে, গ্রামে-শহরে, কেন্দ্রে-বিকেন্দ্রে
মাৎসন্যায়, জেনোসাইড। ফকিরেরা এসে দাঁড়ায় কবিতার
কাতারে। সর্বদিকে জোতদার, জমিদার, দেওয়ানি, প্রাইভেট লিমিটেড কর্পোরেটের মতোন রাষ্ট্র হা-মুখ স্বৈরাচারে মাতে যেনো সে কোনো এক লুপ্ত
বা লুপ্তপ্রায় কিংবা আগামীর কোনো ঈশ্বরাল্লাহ্।
পেরিয়ে
আসি নখের আঁচড়। আদতে আত্মগোপন করি, সেক্সিসংগ্রামে। গদ্যে বলি সে গোপন ইস্তাহার “সোমত্থ ব্লেডের সহিত ইবলিশের যে দুরন্ত সেক্সিমিলন ইহাকেই
কাব্যি বলেছেন সাধো”।
আমার জন্মদাত্রী স্পেকট্রামে ভাসমান তামাম কেওস ও ক্রাইসিস।
বধ্যভূমিতে বসে বাধ্যত লিখি। বিক্ষুব্ধ ব্লেড দরিয়া গায়, সমানে গলে পড়ে মহাঘড়ি, কালচক্র। এইখানে র্যাপে-রকে-হিপহপে-মিলাদে-কীর্তনে আসর
মাতায় প্রিয় বমনেরা, রমণকে ডাকে বগা (বগা=মুই)। এক আউলিয়া এক বাউদিয়া এক বোহেমিয়ান, এক একা মৈষাল, একা মাহুত— ভাতের তীর্থে, বিষভুবনে গণগান ধরে। এই বিগ বিগ ব্যাং-হরিণী-গোরু-গিরগিটি-বেজি-ছুঁচোর
মেহেফিলে নূতন হই, উপজাই, লয় হয়, ক্ষয় হয়। প্রক্রিয়াটির নাম কবিতা, গিনিপিগটি আমি। হতে হতে স্বয়ং কবিতা হই। আর অহং কবি হয়।
[রাজেশ
চন্দ্র দেবনাথ সম্পাদিত ত্রিপুরার ছোটো কাগজ ‘দৈনিক বজ্রকণ্ঠ’-এ (২০২০) প্রথম প্রকাশিত]